দাসপার্টির খোঁজে নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন সালেহ ফুয়াদ ১লার্চ ২০১৮
বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে একটা প্রচলিত মিথ আছে যে তিনি সংকট কালে স্বাধীনতা সংগ্রামে দক্ষ নেতৃত্ব দিলেও শান্তিকালে দেশ পরিচালনায় অদক্ষ ছিলেন। এর প্রেক্ষিত হিসেবে তৎকালীন ভয়ংকর দুর্নীতিকে উদ্ধৃত করা হয়। একটা কথা বারবার পুনরাবৃত্ত করলে অন্তর্নিহিত প্রষ্টব্য অনুমিতিগুলো ঢাকা পড়ে যায়। দুর্নীতির দাবি অনেকগুলো যেমন সত্য ছিলো, অনেকগুলোই ছিলো গুজব (মুজিব তনয়ের ব্যাংক ডাকাতির গুজব একটা উদাহরণ)। তবে দুর্নীতির চটকদার প্রশ্নে যে গুরুতর প্রশ্নটা জিজ্ঞাসিত হয় না
Read More >>
সেটি হলো - একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে কেমন পরিস্থিতি ছিলো? বঙ্গবন্ধুর কী কী করণীয় ছিলো, আর তিনি কী কী করেছেন?
পাকিস্তানীরা পোড়ামাটি নীতি(scorched earth policy) পালন করতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই সবকিছু পুড়িয়ে দিয়েছিলো। তারা ব্যাংকের টাকা আক্ষরিক অর্থেই পুড়িয়েছে, সড়ক-সেতু উড়িয়েছে, কল-কারখানা গুড়িয়েছে, সমুদ্রবন্দরের জাহাজ ও বিমানবন্দরের বিমান বিচূর্ণ করেছে, জায়গায় জায়গায় মাইন পুতে রেখে গেছে যাতে কোন ত্রাণ সাহায্য আসতে না পারে, দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবিদের খুন করেছে যাতে স্বাধীন দেশের নীতিমালা প্রণয়ন ও মেরুদণ্ড গঠণের কেউ না থাকে, প্রচুর সংখ্যাক সরকারি প্রশাসক ও সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের খুন নয়ত পাকিস্তানে জিম্মি করে রেখেছিলো যাতে স্বাধীন দেশে আইন-শৃঙ্খলা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের হাল ধরার কেউ না থাকে। এর উপর ছিলো আমেরিকা ও সোভিয়েত রাশিয়ার স্নায়ুযুদ্ধের ক্রসফায়ারে পড়ার ভয়, বাংলাদেশকে অস্বীকৃতি দিতে পাকিস্তান - চীন - পলাতক রাজাকার ও মোটাদাগে সকল মুসলিম দেশগুলোর আপত্তি। এতো যে মুসলিম ভ্রাতৃত্বের কথা বলা হয়, সৌদি আরবের বাদশাহর কাছে শেখ মুজিব যখন বাংলাদেশের মুসল্লিদের হজ্ব করার স্বার্থে দেশের স্বীকৃতি চাইলেন, তখন সৌদি বাদশাহ শর্ত বেঁধে দিয়েছিলেন যে বাংলাদেশকে "ইসলামী প্রজাতন্ত্র" ঘোষণা করতে হবে, তাৎক্ষণিক প্রত্যুত্তরে মুজিব মুখের উপর বলে দিয়েছিলেন যে বাদশাহর নিজের দেশই "প্রজাতন্ত্র" নয় আর বাংলাদেশের গঠণতন্ত্রের প্রশ্নে তিনি কোন আপস করবেন না! তার উপর দেশী-বিদেশী চক্রান্ত তো ছিলোই, যার ফলে মার্কিনীরা কিউবার কাছে বাংলাদেশের পাট বিক্রির ছুতোয় বাংলাদেশকে দুর্ভিক্ষের লগ্নে ত্রাণ সহায়তা দিতে অপারগ হয়।
মোদ্দা কথা, মুক্তিযুদ্ধের পর শেখ মুজিবকে একদম শূণ্য থেকে শুরু করতে হয়েছে। কূটনীতি, অর্থনীতি, সমাজকল্যাণ-নীতি, রাজনীতি - প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে একের পর এক লেগোর টুকরো বসিয়ে গোটা দেশ পুনঃনির্মাণ করতে হয়েছে। দেশের ভবিষ্যতের স্বার্থে, অভুক্ত দেশবাসী জন্য ত্রাণ প্রাপ্তির লক্ষ্যে, নিজের অহম বিসর্জন দিয়ে এই দেশের জন্মের বিরোধীতা করা প্রত্যেকটা দেশ থেকে বঙ্গবন্ধুকে স্বীকৃতি আদায় করতে হয়েছে যাতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠণ ও বাণিজ্যিক চুক্তির অংশীদার হতে অন্তরায় না থাকে। যেই নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি এই দেশের জন্ম ঠেকাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন, সেই কিসিঞ্জারকেই ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস থেকে টেলিগ্রামে জানানো হয়েছিলো যে শেখ মুজিবের অসাধারণ নেতৃত্বে এই যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ বিস্ময়কর গতিতে গড়ে উঠছে, এবং সেটা ছাপানো হয়েছিলো নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকায়। মাত্র ৯ মাসের ধ্বংযজ্ঞে খানখান হয়ে যাওয়া একটা দেশ নিশ্চয়ই ৩ বছরের মাথায় সিঙ্গাপুর হয়ে উঠতো না, তবে শেখ মুজিব বছর দশেক সময় পেলে দেশটা হয়ত নিজেই একটা দৃষ্টান্ত হতে পারতো, সিঙ্গাপুরের সাথে তুলনীয় হওয়া লাগতো না; তার আগেই মুজিব ৪ বছরের মাথায় সপরিবারে খুন হোন, তাঁর সকল পরিকল্পনা ও স্বপ্ন চক্রান্ত, কুৎসা ও বিদ্বেষের চোরাবালিতে বিলীন হয়ে যায়।
লেখকের থিসিস হচ্ছে শেখ মুজিব মোটেও অদক্ষ প্রশাসক ছিলেন না, বরং তাঁর পরিকল্পনা তাঁর ব্যক্তিত্বের মতোই অনন্য ছিলো। এই তত্ত্ব প্রতিপাদনে লেখক প্রচুর পরিসংখ্যান ও উপাত্ত উত্থাপন করেছেন। শেখ মুজিবের একের পর এক উদ্যোগ ও বিনিয়োগের বিশাল বিশাল অঙ্কগুলো পড়তে একটু একঘেয়ে লাগতে পারে, তবে মুজিব যে মোটেও অদক্ষ প্রশাসক ছিলেন না তা এই শতেক পৃষ্ঠার ক্ষুদ্র বইয়ের কুড়িটা পাতা পড়লেই উপলদ্ধ হয়।